হাওযা নিউজ এজেন্সি: কারবালার শহীদদের পবিত্র মাথা নরাধম ইয়াজিদের আদেশে দামেস্কে প্রেরণ করা হয়। উবাইদুল্লাহ ইবনে জিয়াদকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল বন্দিদের দামেস্কে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করতে, যার জন্য ১৯ মহররম পর্যন্ত সময় লাগে। অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে, কারবালার শহীদ পরিবার ও বন্দিদের কাফেলা কুফা থেকে দামেস্কের উদ্দেশ্যে ১৯ মহররম রওনা দেয়।
দির ও খ্রিষ্টান সাধুর অলৌকিক অভিজ্ঞতা
মাথা বহনকারীরা প্রথম বিশ্রামের জন্য এক দিরে (খ্রিষ্টান আশ্রম) অবস্থান নেয়। সেখানে তারা শহীদ হুসাইন (আ.)-এর মাথা নিয়ে অবমাননাকর আচরণ করে, খেলায় মত্ত হয় ও আনন্দ-উল্লাসে সময় কাটায়। ঠিক তখনই আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে—একটি রক্তাক্ত লৌহ-কলমসহ হাত একটি দেয়াল থেকে বের হয়ে রক্ত দিয়ে লিখতে শুরু করে:
اَتَرْجُو اُمَّةٌ قَتَلَتْ حُسَیْناً شَفاعَةَ جَدِّهِ یَوْمَ الْحِسابِ؟
“যে জাতি হুসাইনকে হত্যা করেছে, তারা কি কিয়ামতের দিনে তাঁর দাদার (রাসূলের) শাফাআতের আশা করে?”
এই দেখে সকলে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। হাতটি বারবার অদৃশ্য হয়ে যায় এবং পুনরায় ফিরে এসে আরও লেখে:
فَلا وَ الله لَیْسَ لَهُم شَفیع وَ هُمْ یَومَ القیامَة فی الْعَذاب
“আল্লাহর কসম, তাদের জন্য কোনো সুপারিশকারী নেই; তারা কিয়ামতের দিন শাস্তির সম্মুখীন হবে।”
তৃতীয়বার লেখে:
وَ قَد قتلُو الحُسینَ بحکم جَور وَ خالف خَلفَهُم حکم الکِتاب
“তারা হুসাইনকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে এবং আল্লাহর কিতাবের বিপরীতে কাজ করেছে।”
সাধু ও শহীদের পবিত্র মাথার অভিবাদন
রাত গভীর হলে এক খ্রিষ্টান সাধু আশ্রমে বসে বিস্মিতভাবে লক্ষ্য করেন, শহীদ হুসাইনের মাথা থেকে একটি অপার্থিব আলো আকাশের দিকে উঠছে এবং ফেরেশতারা অবতরণ করে বলছে:
السلام علیک یا ابن رسول الله، السلام علیک یا اباعبدالله
“আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক, হে রাসূলের সন্তান! হে আবা আবদিল্লাহ!”
তিনি কাছে এসে জানতে চান, মাথাটি কার। উত্তরে বলা হয়, এটি ‘একজন বিদ্রোহী’র মাথা, যিনি ইরাকের এক বিদ্রোহে নিহত হয়েছেন। তবে সাধু যখন জানতে পারেন যে তিনি হচ্ছেন হুসাইন ইবনে আলী (আ.), যাঁর মা ফাতিমা (সা.আ.) এবং নানা মুহাম্মদ (সা.), তখন তিনি বিস্মিত হয়ে ওঠেন এবং বলেন, ধ্বংস হোক সেই জাতি, যারা তাদের নিজ নবি মুহাম্মদের (সা.) দৌহিত্রকে হত্যা করেছে!”
ঐ সাধু দশ হাজার দিরহাম দিয়ে শহীদের পবিত্র মাথা সারারাত নিজের আশ্রমে রাখার অনুমতি নেন। সারা রাত সাধু কান্নাকাটি করে, সুগন্ধি দিয়ে মাথাটি ধুয়ে নামাজ আদায় করে এবং শেষ রাতে ইসলাম গ্রহণ করে বলেন, “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসূল। আমি আপনার গোলাম, হে আবা আবদিল্লাহ!”
সকালে মাথাটি ফিরিয়ে দেওয়ার পর তিনি পুরোপুরি নিজেকে আহলুল বায়তের সেবায় নিয়োজিত করেন।
সোনার দিরহাম রূপান্তরিত হয়ে যায় মাটির টুকরোয়
দামেস্কের পথে সহচররা একপর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেয় পুরস্কার স্বরূপ প্রাপ্ত দিরহামগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেবে। কিন্তু তারা দেখে সেগুলো স্বর্ণ নয়, বরং মাটির খণ্ডে রূপান্তরিত হয়ে গেছে, যার ওপরে আয়াত লেখা:
فَلا تَحْسَبَنَّ اللَّهَ غافِلًا عَمَّا یَعْمَلُ الظَّالِمُونَ
অন্যায়কারীরা যা করছে, তা থেকে আল্লাহকে গাফেল মনে করো না। [সূরা ইবরাহিম: ৪২]
আরেকটিতে লেখা:
وَسَیَعْلَمُ الَّذِینَ ظَلَمُوا أَیَّ مُنقَلَبٍ یَنقَلِبُونَ
যারা জুলুম করেছে, শিগগিরই তারা জানতে পারবে তাদের পরিণতি কী হবে। [সূরা আশ-শোয়ারা: ২২]
ইমাম হুসাইনের মাথা যেখানে যেখানে থেমেছে—স্মৃতিসৌধে রূপান্তরিত
ইবনে শহর আশোবের বর্ণনা মতে, শহীদ ইমাম হুসাইনের মাথা যেসব স্থানে বিশ্রাম নিয়েছে সেসব স্থান পরবর্তীতে তীর্থস্থানে পরিণত হয়—যেমন কারবালা, আসকালান, মসুল, হামা, হামস, দির, দামেস্ক ইত্যাদি।
সাধুর শোকগাথা— এক অপার্থিব কাব্যিক হুঙ্কার
খ্রিষ্টান সাধুর মুখে উচ্চারিত এক হৃদয়বিদারক ও গভীর মর্মস্পর্শী শোকগাথা:
من زادة پیغمبرم راهب ای راهب، من نور چشم حیدرم راهب ای راهب...
“আমি নবীর দৌহিত্র, হে সাধু! আমি হায়দারের নয়নমণি, হে সাধু!”
এ শোকগাথায় হুসাইন (আ.) তাঁর বংশ পরিচয়, ঐশী মর্যাদা এবং কারবালার পটভূমি বর্ণনা করেন, যা শুধু একটি কবিতা নয়, বরং হৃদয়বিদারক এক ইতিহাসের শ্রবণযোগ্য সংকলন।
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদতের পর তাঁর মাথা বহনকারী কাফেলার এই অলৌকিক ঘটনা ইতিহাসের পাতায় শুধু শোকের বার্তা নয়, বরং মানবতার জাগরণ, অন্তর্দৃষ্টি ও আত্ম-অনুশোচনার এক জ্বলন্ত বাতিঘর।
আপনার কমেন্ট